উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ নিজের ঈদ বোনাস আর পুরস্কারের টাকায় প্রতিবন্ধীকে রিকশা কিনে দিলেন পুলিশ সদস্য জিহাদ হাসান
স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী ঝাউতলা এলাকায় থাকেন বাক্প্রতিবন্ধী রিকশাচালক মো. মিজান। প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্য রিকশাচালকদের তুলনায় যাত্রী পান কম। কারণ, যাত্রীদের ডেকে তুলতে পারেন না। তাঁর ওপর রিকশাটি ভাড়ায় নেওয়ায় মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। তবে এখন থেকে তাঁকে ভাড়া করা রিকশা চালাতে হবে না। মিজান নিজেই এখন একটি রিকশার মালিক।
বাক্প্রতিবন্ধী মিজানকে এই রিকশা কিনে দিয়েছেন এক পুলিশ সদস্য। তাঁর নাম জিহাদ হাসান। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ শাখায় কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত আছেন। সেখানে তিনি দাপ্তরিক কাজ করেন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে পাওয়া বোনাস এবং নিজের পুরস্কারের টাকা দিয়ে রিকশাটি তিনি কিনে দিয়েছেন।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে নগরের দামপাড়া এলাকায় পুলিশ লাইনসের সামনে মিজানের হাতে জিহাদ হাসান রিকশাটি তুলে দেন। সেখানে মিজানের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও প্রতিবেশী কুলসুম বেগমের মাধ্যমে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মিজানের স্ত্রী অসুস্থ থাকায় আসেননি। তবে বাবার আনন্দের অংশীদার হতে এসেছিল ছেলেদের দুজন।
মিজান হাতের ইশারায় কথা বলছিলেন, আর সেই প্রতিবেশী প্রথম আলোকে তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
মিজান জানান, এক বেলা রিকশা চালালে আয় হোক কিংবা না হোক, মালিককে তাঁর ৮০ টাকা দিতে হয়। আর সারা দিন চালালে দিতে হয় ১২০ টাকা। মালিককে টাকা দেওয়ার পর যে টাকা থাকে, তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টকর। মাঝেমধ্যে রিকশা চালাতে না পারলে ধার করতে হয়। আবার রাস্তায় বেশ কয়েকটি রিকশা থাকলে চালকেরা যাত্রীদের ডেকে তুলে নেন। কিন্তু তিনি যাত্রীদের ডাকতে পারেন না। ইশারা দিতে হয়। অনেক যাত্রী তা বোঝেন না। আবার ভাড়া নিয়েও দরদাম করতে পারেন না। ইশারায় সবকিছু করতে হয়।
নিজে রিকশার মালিক হয়ে এখন অনেক খুশি মিজান। তিনি জানান, দিনভর রিকশা চালিয়ে যে আয় হবে, তা এখন পুরোপুরি সংসারের জন্য খরচ করা যাবে। অসুস্থ হয়ে রিকশা চালাতে না পারলে সেদিন ভাড়ায় দিয়ে দেবেন।
২০১৬ সালে পুলিশে যোগ দেওয়া জিহাদ ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এখন শুধু মা-ছেলের সংসার। তিনি চট্টগ্রামে থাকেন আর মা কুমিল্লার মুরাদনগরে গ্রামের বাড়িতে। ১৮ হাজার টাকা বেতন তাঁর। সঙ্গে চাল, ডাল, আটা, চিনি, তেল রেশন পান।
ঈদের বোনাসের টাকা মানুষ সাধারণত নিজের কিংবা পরিবারের জন্য খরচ করেন, অচেনা এক লোকের জন্য কেন খরচ করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জিহাদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার কী আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
ঈদের খরচ কীভাবে জোগাড় করবেন, জানতে চাইলে জিহাদ বলেন, ‘দুটি ঈদের বাড়তি খরচের জন্য প্রতি মাসে কিছু কিছু করে সঞ্চয় করে রাখি। এগুলো দিয়ে হয়ে যায়।’
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে কোনো বছর দুই ঈদের বোনাসের টাকা নিজের জন্য খরচ করেননি জিহাদ। কারও চিকিৎসায় কিংবা কাউকে স্বাবলম্বী করতে ব্যয় করেছেন। গত ঈদুল ফিতরেও বোনাসের টাকায় এহসানুল আবেদীন (শিহাব) নামের এক ডেলিভারিম্যানকে বাইসাইকেলে কিনে দিয়েছিলেন জিহাদ। এ নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইনে ‘সাইকেল পেয়ে এহসানুলের মুখে যে হাসি দেখেছি, তার মূল্য অনেক’ শিরোনামে ১৯ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এটি নজরে আসার পর ওই দিনই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জিহাদকে ১০ হাজার টাকা পুরস্কৃত করেন। অনলাইনে বাইসাইকেল কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন এহসানুল।
জিহাদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যারের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া ১০ হাজার টাকা, ঈদুল আজহাতে বোনাস পাওয়া ১২ হাজার ৮০ টাকা, নিজের হাজারখানেক টাকাসহ ২৩ হাজার টাকায় রিকশাটি কিনেছি।’
জিহাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। তিনি বলেন, ইচ্ছা থাকলে যেকোনো মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, তার প্রমাণ কনস্টেবল জিহাদ হাসান। গত ঈদের বোনাস এক অসহায়কে দেওয়ায় তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। সেই টাকা নিজে খরচ না করে এবার আরেক অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মতো সমাজের আরও অনেকের এগিয়ে আসা উচিত।
এদিকে এত রিকশাচালক থাকতে মিজানকে কেন বেছে নিয়েছেন, প্রশ্নের উত্তরে জিহাদ হাসান বলেন, ‘এবারের ঈদের বোনাসের টাকা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরিচিতজনের মাধ্যমে অসহায় লোক খুঁজতে থাকি। পরে জানতে পারি, বাক্প্রতিবন্ধী এক রিকশাচালক রয়েছেন। যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে রিকশা কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
ছেলের এমন কাজ নিয়ে গর্ববোধ করেন জিহাদের মা জেসমিন বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে প্রয়োজনমতো আমাদের জন্য খরচ করে। বাড়তি বিলাসিতা না করে বোনাসের টাকায় গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, এটি অনেক বড় পাওয়া।’






Visit Today : 253
Visit Yesterday : 371
This Month : 8618
Hits Today : 336
Total Hits : 2767883


