শূন্য থেকে উঠে আসা একজন মুকুল

মুকুল স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। আজ হয়তো ক্যাম্পাসে অনেক তার নামডাক আছে। তার জীবনের লড়াই আর সফলতা অনেকটা রূপকথার মতো। দারিদ্রকে জয় করে, সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন ক্যাম্পাসে। আশপাশের সবাই এখন তাকে এক নামে চেনে। অথচ একটা সময় ছিলো যখন সে বিক্রি করেছেন জলপাই, কখনো হয়েছেন গাড়ির হেলপার!

গল্পের পেছনে একটা গল্প থাকে। আপনারা হয়তো অনেক গল্প শুনেছেন। কীভাবে পারিবারিক সমস্যা উতরে নিজেকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়, সেটাই এ গল্পের উপজীব্য। কথাগুলো বলছিলাম জীবনযুদ্ধে হার না মানা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম মুকুল সম্পর্কে।

মুকুল বলেন, আমি যখন বুঝতে শিখি তখন সংসারের প্রচণ্ড অভাব দেখতাম, আমার মা মানুষের বাড়িতে কাঁথা সেলাই করতেন আর বাবা মানুষের  বাড়িতে কাজ করতেন। যখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি বাড়ির পাশে সিকদার হাটে কালী পুঁজো হতো আর কাঠালতলী বাজারে লক্ষ্মী পুঁজো হতো। সেই পুঁজোয় জলপাই বিক্রি করতাম। অনেক সহপাঠী পুঁজোয় বেড়াতে আসতো। আর আমি ছলছল চোখে তাকাতাম।পরে ক্লাসে সহপাঠিরা আমার সঙ্গে কথা বলতো না।

তিনি বলেন, যখন পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় হলো, কিন্তু টাকার অভাবে নির্ধারিত সময়ে ভর্তি হতে পারি নাই। তখন বাড়ির পাশে মজিব চাচা ছিল। তাকে বললাম টাকার অভাবে আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারছি না। আপনি যদি আমাকে কাজে নিতেন। পরে তিনি বললেন, তুমি তো ছোট বাবা! তারপরও যেহেতু বলছো তাই দিনে এক বেলা খাওয়াবো আর পঞ্চাশ টাকা দিব। আমি কোনো উপায় না পেয়ে তার শর্তে রাজি হলাম। দশদিন কাজ করে পাঁচশ টাকা পাইছিলাম। সেদিন আমার জীবনের প্রথম অর্জন ছিল। অনেক খুশি হয়েছিলাম।

তখন সেই টাকা নিয়ে স্কুলের পথে। স্কুলে ভর্তি হবো, কিন্তু স্যারেরা ভর্তি নিচ্ছিলেন না। কারণ ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেছে। পরে যখন আমি আমার ঘটনাটি খুলে বললাম, পরে তারা রাজি হলেন। ভর্তি নিলেন আমাকে। তখন আমার রোল নম্বর নব্বই হলো। আমার পর কাউকে ভর্তি নেয়া হয়নি।

তিনি আরো বলেন, একটা সময় এমন গেছে আমরা তো তিনবেলা ভাত খেতে পারতাম না। যখন আলু মৌসুম আসতো, আলু সিদ্ধ করে খেতাম। এতে ভাত কম লাগতো! এভাবেই ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পার করলাম।

যখন ভালোভাবে বিষয়গুলো বুঝতে শিখি, তখন কখনো গাড়ির হেলপার, আবার কখনো সেই চাচার বাড়িতে কাজ করতাম। তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় কাজ করে একটা ছাগল নিয়েছিলাম।

আমরা সাত ভাই, তিন বোন ছিলাম। পরিবারে সমস্যা লেগেই ছিলো। তবে আমি হাল ছেড়ে দেইনি কখনো। এরপর দশম শ্রেণিতে আমি মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম, কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করি। শিক্ষকরা তো আমাকে নিবেন না, আমি তাদের বললাম স্যার আমাকে নেন কিছু করব। পরে জরিমানা ফি দিয়ে তারা নিলেন এবং বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিলেন। বোর্ড পরীক্ষা দিলাম। এরপর আসলো সেই রেজাল্টের দিন। এসএসসি পরীক্ষায় কচুবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলাম। আমার রেজাল্ট শুনে সবাই অবাক হয়েছিল। এরপর ঠাকুরগাঁও কলেজে পদার্পণ করি।

অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কাজ করে, কিন্তু আমি তাদের থেকে ভিন্ন। কারণ আমি কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া করি।এর মাঝেই আবার ভাইয়েরা বিয়ে করে আলাদা সংসার করলো। আমার ওপর চাপ বেড়ে গেলো। এভাবেই কেটে গেলো সময়গুলো। এরপর এইচএসসি পাশ করলাম। আমার অনেক সহপাঠী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার জন্য কেউ ঢাকায়, কেউ রংপুরে কোচিং করছিল। অন্যদিকে আমি ঠিকমতো চলতেই পারি না, কোচিং করা তো দূরহ ব্যাপার। যতটুকুর সময় পেতাম, বাড়িতে নিজের পড়াশোনা করে চান্স পেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বাবা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়া বাদ দিয়ে চলে আসলাম সেবা করার জন্য বাবা-মায়ের কাছে।

এভাবেই কেটে গেলো ছয় মাসের অধিক সময়। পরে বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় দ্বিতীয়বার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়  বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদে পয়ত্রিশতম হই। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলি, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম বিতরণ চলছে, তখন সময়টা আশ্বিন-কার্তিক মাস চলে। সে সময় প্রচুর অভাব ছিলো, হাতে কাজও ছিলো না। ফলে টাকা ছিলো না ফরম নেয়ার মতো। মাকে বিষয়টি যখন বলি মায়ের তেইশটা হাঁস ছিলো, সেগুলো বিক্রি করে বেগম রোকেয়া ও হাজী দানেশের ফরম তুলি।

এভাবেই মনিরুল ইসলাম মুকুল তার জীবনের গল্প শোনালেন। মুকুলের আগে থেকেই লেখা-লেখির অভ্যাস ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর সে তিনটা টিউশনি করিয়েছিল। একটা টিউশনির টাকা মাকে দিতেন, একটা জমিয়ে রাখতেন বই প্রকাশ করার জন্য। আর একটা টিউশনির টাকা দিয়ে মেসের খরচ চালাতো।

নিজের প্রচেষ্টায় ২০২০ সালে ‘শান্ত মেঘে লুকিয়ে তুই’ প্রকাশিত হয়, ২০২০ সালে ‘উপন্যাসিক মৃত্যু পান্ডুলিপি’, ২০২২ সালে গল্পগ্রন্থ ‘শয়তান গ্রহ’ প্রকাশিত হয়।

মুকুলের চাওয়া, তার অনেক লেখা জমে আছে। যদি ঢাকার কোন প্রকাশনা তার লেখাগুলো প্রকাশ করতেন বই আকারে। তাহলে তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতেন এবং অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা পেতেন।

Eadmin

Related post