বিশ্বের ১৯৩টি দেশে মাত্র ১০ জন তরুণীর মধ্যে গবেষণার জন্য বাংলাদেশের মারজানা পেয়েছেন জাতিসংঘের পুরস্কার
কলেজে জীববিজ্ঞান ক্লাসে মাইক্রোস্কোপে প্রথম কোষ দেখেন মারজানা আক্তার। মুহূর্তে তাঁর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে কাচের স্লাইডের নিচে থাকা ক্ষুদ্র একটা জগৎ। তখন হয়তো ভাবতেও পারেননি, মাইক্রোস্কোপে দেখা কোষ থেকে শুরু হওয়া তাঁর যাত্রা জাতিসংঘের বায়োসিকিউরিটির বৈশ্বিক মঞ্চে গিয়ে থামবে।
ছোট শহরে বেড়ে ওঠা মারজানা সব সময়ই ছিলেন কৌতূহলী। বিজ্ঞানের বই, জীববিজ্ঞানের গল্প, সবকিছুতেই ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। জীবনের একেবারে আণবিক পর্যায়ের রহস্য বোঝার ইচ্ছা থেকেই বেছে নিয়েছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ।
সেখানেই প্রথম উপলব্ধি করেন, প্রতিটি প্রোটিন, জিন, এনজাইম একেকটি গল্প বলে। এই গল্প বুঝতে হলে ল্যাবই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সেই ভাবনা থেকেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন শুরু করেন। এখানে জীবাণু, ভাইরাস ও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পান মারজানা।
তবে এই স্নাতকোত্তর যাত্রা মোটেও মসৃণ ছিল না। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ই সন্তানসম্ভবা হন। সকালে ক্লাস, বিকেলে ল্যাব, রাতে থিসিস লেখা—সবকিছুই একসঙ্গে চলছিল। গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে গুরুতর শ্বাসকষ্টে তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয়, পাঁচটি ভয়াবহ দিন কাটান হাসপাতালের বিছানায়।
তবে এই ভয় মারজানাকে দমাতে পারেনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই প্রতিজ্ঞা করেন, ‘সুস্থ হয়ে আমার থিসিস শেষ করব।’ সন্তান জন্মের পরও সেই প্রতিজ্ঞা পূরণে অটল থেকেছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও থিসিস ডিফেন্ড করেছেন দৃঢ় মনোবলে।
আর এই পুরো সময়ে মারজানার পাশে ছিল তাঁর পরিবার, জীবনসঙ্গী ইউশা আরাফ এবং গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক গোলজার হোসেন। মারজানা বলেন, ‘স্যার সব সময় বলতেন, নিজের গতিতে এগিয়ে চলো। নিজের ওপর যখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম, সেই মুহূর্তেই স্যার আবার আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে দিতেন।’
মারজানার জীবনসঙ্গী ইউশা আরাফ তখন নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে পিএইচডি করছিলেন। দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন ফোনকলে ঠিকই পরামর্শ দিতেন, যোগাতেন অনুপ্রেরণা। বায়োসিকিউরিটি ও বায়োলজিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন সম্পর্কে তিনিই প্রথম মারজানাকে বিস্তারিত জানান। এই কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী ফেলোশিপ দিচ্ছে জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণবিষয়ক দপ্তর।
গবেষণার ক্ষেত্রেও মারজানার কাজ ছিল ব্যতিক্রমী। বাংলাদেশের পোলট্রিতে প্রথমবারের মতো তিনি শনাক্ত করেন চিকেন ইনফেকশাস অ্যানিমিয়া ভাইরাসের (সিআইভিএ) ই জিনোটাইপ থ্রিবি স্ট্রেইন। ভাইরোলজি গবেষণায় এটি একটি বড় সংযোজন। গর্ভাবস্থায় এই কাজ চালিয়ে যাওয়া ছিল বেশ কঠিন। মারজানার ভাষ্য, ‘গবেষণাই আমাকে ধৈর্য আর অধ্যবসায় শিখিয়েছে। সম্ভবত এই মানসিকতাই আমাকে ফেলোশিপ নির্বাচনে আলাদা করে তুলেছে।’
গবেষণায় সাফল্য এলেও ভাগ্য সব সময় সহায় হয়নি। জাপানের সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে তাঁর ল্যাব ও ল্যাবের গবেষণা নির্বাচিত হয়েছিল, কিন্তু তখনো তিনি আইসিইউতে। ফলে অংশ নিতে পারেননি। তবে সেটি তাঁর আত্মবিশ্বাস ভাঙতে পারেনি। বরং তিনি সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন, ‘প্রতিটি না পাওয়াই আদতে পরবর্তী সাফল্যের প্রস্তুতি।’
অবশেষে আসে জীবনের সেই মোড় ঘোরানো সকাল। জাতিসংঘের ‘ইয়াং উইমেন ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপ ২০২৫’-এর ইমেইল, ‘কংগ্র্যাচুলেশন! ইউ হ্যাভ বিন সিলেক্টেড…।’ দেখে শুরুতে মারজানার বিশ্বাসই হচ্ছিল না—‘বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্য থেকে মাত্র ১০ জন তরুণী গবেষককে নির্বাচিত করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আমি একজন!’
এই ফেলোশিপকে শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখছেন মারজানা। ডিসেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে সমাপনী অনুষ্ঠান, যেখানে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
বর্তমানে মারজানার গবেষণার বিষয় বায়োসিকিউরিটি। এটির লক্ষ্য হলো জীববিজ্ঞানের জ্ঞানকে মানবকল্যাণের পথে ব্যবহার, জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও ল্যাব সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তিনি চান, বাংলাদেশে তরুণ গবেষক, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি হোক। তাঁর মতে, ‘মেয়েরা গবেষণাসহ সব ক্ষেত্রে সমানভাবে সফল হতে পারে। শুধু দরকার বিশ্বাস, অধ্যবসায় আর সঠিক দিকনির্দেশনা।’
মারজানা আজ ৯টি গবেষণাপত্রের লেখক; একজন মা, একজন গবেষক। মেয়ে আনাইজার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন নতুন শক্তি পান তিনি। তাঁর চাওয়া, আনাইজা একদিন গর্ব করে বলুক, ‘আমার মা কখনো হাল ছাড়েনি।’







Visit Today : 772
Visit Yesterday : 195
This Month : 1998
Hits Today : 1241
Total Hits : 2779001

